মহালয়ার এ দিনে মা এলো বাপের বাড়ি
বিশেষ নিবেদন-
বর্ষার দীর্ঘ বর্ষণ শেষে যখন সাদা তুলোর পেঁজার মতো মেঘদল আকাশে ভেসে বেড়ায়, রাতে ঝরে মৃদু শিশির, তখন শরতের প্রাক্কালে অরুণ রাঙা দৃপ্ত চরণে সূচনা হয় দেবীপক্ষের। শাঁখ-কাঁসার শব্দে, উলুধ্বনিতে, চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে মর্ত্যালোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। শ্রী শ্রী চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার ধরাধামে আগমনই শুভ মহালয়া হিসেবে পরিচিত। অসুরনাশিনী দেবী দুর্গা প্রতি বছর মর্ত্যে আসেন তার ভক্তকূলের জন্য শক্তির বর নিয়ে।
দুর্গাপূজার মূল উৎসবকাল পাঁচদিন- মহা ষষ্ঠী, মহা সপ্তমী, মহা অষ্টমী, মহা নবমী ও বিজয়া দশমী। বিজয়ার দিনে দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক ত্যাগ করে ফেরত চলেন। তবে দেবী দুর্গা কবে আসেন মর্ত্যে? এর উত্তরই শুভ মহালয়া। মহালয়া শব্দের আক্ষরিক সমার্থ হলো ‘আনন্দ নিকেতন’। দেবী মায়ের আগমনী সুরে আনন্দের বার্তা আসে পৃথিবী জুড়ে। দেবীপক্ষের সূচনাকালেই ধরাধামে আবির্ভূত হন দুর্গা। চাঁদের হিসেব অনুসারে দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্বের অমাবস্যার দিনে। এই দিনটিই মহালয়া নামে পরিচিত।
পঞ্চদশীয় চান্দ্র আবর্তনের মাঝে সাধারণত পনেরোটি তিথি থাকে। এই সব কয়টিকেই মহালয়ার তিথি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হলো প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। সনাতনী বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাকে তার পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়।
মহালয়ার দিনটি হচ্ছে পিতৃপক্ষের শেষদিন এবং দেবীপক্ষের সূচনা। সনাতন ধর্মমতে, পিতৃপক্ষ পূর্বপুরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। এই পক্ষ পিতৃপক্ষ, ষোলা শ্রাদ্ধ, কানাগাত, মহালয়া পক্ষ ও অমরপক্ষ নামেও পরিচিত। মহালয়া মূলত পূর্বপুরুষের পূজার বিশেষ তিথি। হিন্দু সংস্কৃতিতে ধর্মীয় কার্যাদি সাধারণত দিন হিসেবে হয় না, বরঞ্চ তিথির হিসেবে হয়ে থাকে। সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করতে হয়, সেই তিথিতে করতে হয়, যে তিথিতে তারা প্রয়াত হয়েছেন।
প্রথানুসারে মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন, তারা তাদের পূর্বপূরুষকে স্মরণ করে, পূর্বপূরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই পিতৃলোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং এভাবে মৃত ব্যক্তি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এ কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মবিশ্বাস বলে, মহালয়ার দিনে মৃত সকল ব্যক্তির আত্মাদের ধরায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রয়াত সকল আত্মার যে মহা এক সমাবেশের সৃষ্টি হয়, তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মূলত মহালয়া শব্দটি এসেছে।