জাতীয়

পূজার ঢাক বাজত বনেদি বাড়িতেই

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বনানী, কলাবাগানসহ বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে তৈরি পূজামণ্ডপেও বেশ জাঁকালো পূজার আয়োজন হচ্ছে।

জেমস টেলর ছিলেন ঢাকার সিভিল সার্জন। আট বছর ঢাকায় থাকাকালে এই শহরকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। সংগ্রহ করেছিলেন ঢাকা ও আশপাশের প্রচুর তথ্য। তাঁর লেখা বই টপোগ্রাফি অব ঢাকা প্রকাশিত হয় ১৮৪০ সালে কলকাতা থেকে, যে বইটির বাংলা নামকরণ করা হয় কোম্পানি আমলে ঢাকা। ১৮৩ বছর আগে প্রকাশিত বইয়ে তিনি ৪০০ বছরের এই শহরের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের কথা লিখে গেছেন। এতে ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে মহররম, বেরা ভাসান এবং বৈষ্ণব উৎসবের কথা বলেছেন। তবে বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা নিয়ে কিছু উল্লেখ করেননি তিনি।

ইংরেজ সাহেবের লেখা ছেড়ে এবার আমরা আসি স্বদেশির লেখায়। এগিয়ে যাই আরও চার দশক সামনে। হৃদয়নাথ মজুমদার ছিলেন একজন আইনজীবী, ঢাকারই বাসিন্দা। তাঁকে নিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, হৃদয়নাথের ঢাকা শহর। এই হৃদয়নাথ (১৮৬৪-১৯০৫) তাঁর আত্মজীবনীতে উনিশ শতকের সত্তরের দশকের নানা কথা বলেছেন। এখানে তিনি ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ না করে বলেছেন হোলি, ঝুলন আর মহররমের কথা। কেন দুর্গাপূজা তখনো হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হয়ে ওঠেনি, তার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তখন ঢাকা ছিল বৈষ্ণব শহর। এই ধারা বজায় ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও।

বারোয়ারি পূজা বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ চাঁদা তুলে সামাজিকভাবে পূজার আয়োজন, তা অবশ্য তখন শুরু হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু এলাকায়; কিন্তু ঢাকায় নয়। ঢাকায় দুর্গাপূজা হতো বিভিন্ন বাড়িকেন্দ্রিক। যেমন রায়বাড়ির পূজা, মুখার্জিবাড়ির পূজা, চক্কোতি (চক্রবর্তী) বাড়ির পূজা। সেসব পূজায় অন্য ধর্মের মানুষ তো দূরের কথা, কুলীন ব্রাহ্মণ না হলে সেখানে কারও প্রবেশাধিকার ছিল না।

সে কথাই লিখেছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও লেখক ভবতোষ দত্ত (১৯১১-১৯৯৭), যিনি পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ইমেরিটাস অধ্যাপক হয়েছিলেন, তাঁর আত্মজীবনী সাত দশক গ্রন্থে। বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করলেও ভবতোষের স্কুল ও কলেজের পুরোটা সময় কেটেছে বাংলাদেশের খুলনায়, ময়মনসিংহ ও ঢাকায়। তিনি লিখেছেন, ‘পূজা দেখতে যেতাম সূত্রাপুরের (মৈসুণ্ডি) বাবু নন্দলালের বাড়িতে, যেখানে দোতলাসমান বড় প্রতিমা হতো। সবচেয়ে বেশি যেতাম টিকাটুলী ছাড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পূজায়। আমরা সবাই মিলে কাজ করতাম। ভিড় সামলানো থেকে দর্শনার্থীদের জুতার খবরদারি করা পর্যন্ত। সন্ন্যাসীরা কীর্তন করতেন, আমরাও তাতে যোগ দিতাম।’ প্রসঙ্গত, নন্দলাল বাবু তখন সূত্রাপুরের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।

ভবতোষ দত্তের লেখা থেকে স্পষ্ট, তখনো ঢাকায় দুর্গাপূজা সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। নিজেও সে কথা লিখেছেন। তাঁর মতে, ঢাকায় তখন অনেক মন্দির ছিল বটে, সেগুলো ঝুলন উৎসবের সময় সাজানো হতো। দোল উৎসবের পর ঝুলন উৎসব ছিল বৈষ্ণবদের অন্যতম বড় উৎসব।
উৎসবের ঢাকা বইয়ে সাদ উর রহমান লিখেছেন, দুর্গাপূজার সর্বজনীন রূপ দেখা যায় দেশভাগের পর। সে সময় সম্ভ্রান্ত অনেক হিন্দু ঢাকা ছেড়ে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তখন ঢাকায় এককভাবে পূজা আয়োজন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে চাঁদা তুলে পূজার আয়োজন করা হতো। যদিও তখনো পারিবারিকভাবে পূজার আয়োজন করা বাদ যায়নি। বেশ চলত, যা এখনো পুরান ঢাকায় কিছু কিছু রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ এবং মহানগর সর্বজনীন পূজা উদ্‌যাপন কমিটি। ঢাকার প্রাচীন এই মন্দিরে প্রতিবছর দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয় মহাসমারোহে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ মন্দির, জয়কালী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশনসহ বিভিন্ন মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয় মহা ধুমধামের সঙ্গে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বনানী, কলাবাগানসহ বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে তৈরি পূজামণ্ডপেও বেশ জাঁকালো পূজার আয়োজন হচ্ছে।

১৯৬৮ সাল থেকে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে বাস করছেন নেপাল মালাকার। স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এই ব্যক্তি ফিরে গেলেন ঢাকায় তাঁর শৈশবে। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বলছিলেন, এখন যেমন শহরের নানা এলাকায় অস্থায়ীভাবে মণ্ডপ বানিয়ে পূজা হয়, তখন তা ছিল না। তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজারে দুটো অস্থায়ী মণ্ডপ বানানোর কথা স্মরণ করতে পারলেন তিনি। জানালেন, বনেদি বাড়িতেই পূজা বেশি হতো। সব মিলে পূজার আয়োজন ও উদ্‌যাপন এখন অনেক বেশি বলে তাঁর পর্যবেক্ষণ।

দুর্গাপূজার প্রসাদ ও খাবার

এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকাই খাবার বইয়ের ‘ঢাকার ধর্মীয় উৎসবের খাবার’ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, পূজার প্রথম পাঁচ দিন হিন্দুরা নিরামিষ খাদ্য খেয়ে থাকেন। প্রসাদ হিসেবে নিরামিষ, সবজি সহযোগে ভুনা খিচুড়ি, সাদা পোলাও, আমৃতি, সন্দেশ, লাড্ডু খাওয়া হয়। আর বিজয়া দশমীর দিনে অতিথিদের সাদা আঁশের বড় মাছ যেমন রুই মাছের ঝোল, ভাত, পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এদিন লাড্ডু আর জিলাপি একজন আরেকজনের বাড়িতে বিলিয়ে থাকেন।

ঢাকায় রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী শান্তিকরানন্দ মহারাজ গতকাল শুক্রবার জানালেন, ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত খাদ্য-খাবারের আয়োজন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক আচার অনুযায়ী হয়ে থাকে।

আরো দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button